শনিবারে কোথায় যাওয়া যায় ভাবছিলাম, হঠাত করেই দিদার ভাই প্রস্তাব দিল, আমি একবাক্যে রাজী। শেষ পর্যন্ত সবাই রাজী, শুধু শামসীর ভাই, আর নাগ বাবা ছাড়া। অতঃপর এরেঞ্জমেন্টস এবং রওনা। কিন্তু আমাদের ভাই বেরাদারগোর একটা সুন্দর অভ্যাস আছে, টাইম দিলে টাইম রাখার ব্যাপারে উনারা খুব একটা ইন্টেরেষ্টেড না, দুয়েকটা ব্যাতিক্রম আছে (আমি একজন)।
যাই হোক, অনেকক্ষন দাঁড়ায়া থাকার পরে ৯ টার সময় উত্তরা থেকে গাড়ীতে উঠলাম, পেটে ক্ষুধা, মনে আশা। কতক্ষনে পৌছাবো, কখন খাব। এইবার রাস্তাপথের বিবরন দিয়ে নেই একটু। উত্তরা পার হয়ে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে হাতের ডান দিকে ঢুকে বেশ কিছুটা আগালে আহসানউল্লাহ মাষ্টার ফ্লাই ওভার। সেটা পার হয়ে বেশ কিছুক্ষন গেলে মীরের বাজার নামে একটা চৌরাস্তা পড়বে। সেটা দিয়ে সোজা এগিয়ে রেললাইনের আগে হাতের বামে ঢুকে গেলেই আপনি ধরে নিতে পারেন, “ইউ আর অন ট্র্যাক”। সেই রাস্তায় বেশ কিছুক্ষন আগালেই জল জংগলের কাব্য। চিনতে কষ্ট হতে পারে, কোন সাইনবোর্ড নাই, একটা ছোট লোহার গেট, তালা মারা, এইটুকুই। স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করে খুব একটা লাভ হবে না, আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম একজনকে,
ঃ ভাই, জল জঙ্গল জায়গাটা কই বলতে পারেন?
ঃ এইদিকে তো জল জঙ্গল অনেক আছে, কুন্টায় যাইবেন?
যাইহোক, পৌছানোর দায়িত্ব আপনার নিজের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি বরং জল ও জংগলের কাব্যে ঢুকি।
গেট দিয়ে ঢুকতেই সামনে একটু খালি জায়গা, গাড়ী রাখার জন্য। প্রথম দর্শনে খুব একটা চমতকৃত হলাম না, একজন এটেন্ডেন্ট এসে নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করে বলল, আসেন আমার সাথে। সরু গ্রামের পথ দিয়ে অল্প একটু হাঁটার পরেই একটা ঘরে বসতে বলল, পাটশোলার ঘর, একটা খাট আছে, দুসেট সোফা, আরেকটা ডিভান টাইপ, ঘরের চারদিকে খোলা। পুরা ঘর এবং ঘরের চারপাশে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ছাপ এবং শান্তির ছাপ।
কিন্তু বিধি বাম, একটু পরেই আরেকজন এসে জানালো, এই ঘরটা আমাদের না, এইটা আরেক পার্টির। শুনে একটু হতাশ হলাম, এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে কই না কই নিয়া ফালাবে। কিন্তু এবার আমাদের চমকানোর পালা, আমাদের দুই তালা একটা ঘর দিল, যার নিচ তালায় খাট, সোফা, সেন্টার টেবিল, আর দুই তালায় খালি, পুরো কাঠের ফ্লোরে তোশক বিছানো।
সামনে তাকাতেই মুগ্ধ। চোখের সামনে অবারিত খোলা মাঠ, বিল।
ঘরের সামনে মাচায় বেশকিছুক্ষন বসে সে নীরব সৌন্দর্য উপভোগ। নীরব বলা ঠিক হবে না, নিচে বাউলদের দুতারার টুংটাং শব্দ আর দরাজ কন্ঠের বাউল গান যেন পরিবেশের সাথে মিশে যাচ্ছিল। একদম অন্য রকম একটা পরিবেশ।
এরই মধ্যে সকালের নাস্তার ডাক পরল। চিতই পিঠা, চালের রুটি, লুচি, সাথে মুরগীর মাংস, বুটের ডাল, সবজি। আহা! অমৃতের মত লাগল।
নাস্তার পালা চুকতেই তারেক ভাই আর খায়ের ভাই একটা নৌকা নিয়ে বের হয়ে গেল ভ্রমনে।
আমরা কয়েকজন এদিক ওদিক ঘুরে ছবি তোলায় মনোযোগ দিলাম।
প্রাথমিক ঘোরাফেরা শেষে আরেকটা নৌকা নিয়ে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম, আমি আর রাব্বি ভাই মাঝি, যাত্রী রসি ভাই আর দিদার ভাই। তারেকভাই সিঙ্গেল একটা ক্যানো নৌকা নিয়ে।
এর আগে দুয়েকবার নৌকা চালালেও কৌশলটা রপ্ত করতে অনেকক্ষন সময় লেগে গেল, কৌশলটা একবার বুঝে ফেললে চালানো সহজ, কিন্তু কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যাই হোক, নৌকাভ্রমন শেষে আরেকদফা ফটোসেশন শেষ করে নজর দিলাম গানা বাজনার দিকে, ঘন্টা দুয়েক মনের আনন্দে গান বাজনা হলো, বাউল দল গাইছে, বাজাচ্ছে, আর আমরা যে যার খুশি মত যেকোন একটা বাদ্যযন্ত্র তুলে নিয়ে মনের সুখে তাদের সাথে গাইছি। যারা অতি আগ্রহী তারা কষ্ট করে এই ভিডিওগুলোও দেখে নিতে পারেন...:)
আরেকটাঃ
এর মাঝেই কাচামরিচ দিয়ে মাখানো গাছের জাম্বুরা খাওয়া শেষ।
নেক্সট? পুকুরে ডুবাডুবি।
শুরুতে আমি নামতে খুব একটা ইন্টারেষ্টেড ছিলাম না, হাফপ্যান্ট বা লুঙ্গি জাতীয় কিছু ছিল না বলে, শেষে পুলাপাইনের ঝাপাঝাপি দেখে আর স্থির থাকতে না পেরে ঐখানে যারা থাকে তাদের একজনের ঘরে যেয়ে বললাম, “আমাকে একটা লুঙ্গি দেয়া যাবে?” বৃদ্ধা উনার সরলতা দিয়ে আমাকে মুগ্ধ করে বললেন, “বাইরে আছে, যেটা ইচ্ছা নিয়ে যান।” লুঙ্গিটা কষে বেঁধে, লাইফজ্যাকেট চড়িয়ে নেমে গেলাম। অনেকদিন পরে ইচ্ছেমত পানিতে ডুবলাম, ভাসলাম।
যখন পুলাপাইন মনের সুখে ডুবাডুবি করছিল, তার মাঝে আমি পুরা এলাকাটা একবার চক্কর দিয়ে ফেললাম, শান্ত শান্ত একটা পরিবেশ,
তার মাঝে পুকুর পাড়ে দেখা পেলাম এই নিঃসঙ্গ ভদ্রলোকের। মনে হচ্ছে, এইমাত্র জমিতে কাজ করে বিশ্রাম নিতে বসেছেন।
এর ফাঁকে রান্নাঘরেও উকি মেরে আসা হল একবার। সুন্দর, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
আসল চমক তো তখনো বাকি। আগেই জানতাম, দুপুরে হেভী খানা দেয়, কিন্তু তাই বলে যে এইরকম সেটা ভাবিনি। প্রায় ১৭ পদের বাঙ্গালী খাবার, কি আছে সেটা বলার চেয়ে সহজ হবে কি ছিল না সেটা বলা। মজার ব্যাপার হল, শুধু টমেটো বাদে আর সবই নাকি ওইখানের পন্য। সবগুলোই চেষ্টা করলাম খেয়ে দেখতে, দুয়েকটা বাদ পরে গেছে মনে হয়।
খাওয়ার পরে ঘন্টাখানের মাচায় বসে আয়েশ, আড্ডা। সন্ধ্যা হয়ে আসার আগেই জায়গাটা আরেকবার ঘুরে দেখার ইচ্ছায় নামলাম মাচা থেকে, আবার ফটোসেশন, শেষ বিকেলের আলোটা অদ্ভুত লাগছিল।
পুকুরের ঘাটে তালের পিঠা আসল, পিঠা খেতে খেতে মিনি একটা আড্ডাও হয়ে গেল।
সেদিন পুর্নিমা ছিল, অথবা তার আগের দিন। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল, ভরা চাঁদের আলোয় জায়গাটা কেমন লাগে। অতঃপর মাচায় বসে চাঁদের জন্যে অপেক্ষা। একটাই আফসোস, এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটা ক্যামেরায় বন্দী করার মত কাবিল আমি না...
আবার কোন একদিন পুর্নিমা রাতে থাকার প্ল্যান করে সেদিনের মত বিদায়।